ঢাকা, ০৪ ডিসেম্বর, ২০২৪
সর্বশেষ:

নবী-রাসূল (আ.)-দের বিশেষ বিশেষ দোয়া (পর্ব-১) 

ধর্ম ডেস্ক

প্রকাশিত: ০৯:১৮, ২০ নভেম্বর ২০১৯  

ফাইল ছবি

ফাইল ছবি

নবী-রাসূল (আ.); তাদের ওপর অর্পিত আমানত নবুওয়াত ও রিসালাতের দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে নানামুখী ষড়যন্ত্র, সীমাহীন অত্যাচার-নির্যাতন এবং বহুবিধ পরীক্ষার সম্মুখীন হয়েছেন। এসব কিছুর এক পর্যায়ে তারা আল্লাহ তায়ালার কাছে কায়মনোবাক্যে প্রার্থনা করেছেন, যা আল-কোরআনে বিধৃত হয়েছে।

নিম্নে কতিপয় নবী-রাসূলগণের (আ.) প্রেক্ষাপট উল্লেখসহ কোরআনের দোয়াসমূহ দেয়া হলো-

(১) আদম (আ.) এর দোয়া: মানব সৃষ্টির সূচনা পিতা আদম ও মাতা হাওয়া (আ.) এর মধ্য দিয়ে আল্লাহ তায়ালা উভয়কে সৃষ্টি করে। আদম (আ.)-কে সকল সৃষ্টির ওপর শ্রেষ্টত্ব দিলেন; যাবতীয় বিষয়ে জ্ঞান দান করলেন এবং তার সম্মানে ফেরেশতাদের দ্বারা সিজদাহ করালেন, অতঃপর শর্তসাপেক্ষে চিরসুখময় জান্নাতে বসবাস করতে বললেন। কিন্তু শর্ত ভঙ্গের দরুন (নিষিদ্ধ বৃক্ষের ফল ভক্ষণ) আদম ও হাওয়া (আ.)-কে জান্নাত থেকে ধুলার ধরণীতে (পৃথিবীতে) নেমে আসতে হলো। 

এসবই ছিল, মহান আল্লাহ সুবহানাহু তায়ালার সুনির্ধারিত পরিকল্পনা। আদম (আ.) ৯৬০ বছর হায়াত পেয়েছিলেন।

পিতা আদম ও মাতা হাওয়া (আ.) সুবিস্তত জান্নাত থেকে সংকীর্ণ পৃতিবীতে এসে শর্তভঙ্গের ভুলের কথা স্বরণ করে আল্লাহ তায়ালার দরবারে তার শেখানো বাক্যের দ্বারা ক্ষমার ফরিয়াদ করতে থাকেন:

رَبَّنَا ظَلَمْنَا أَنفُسَنَا وَإِن لَّمْ تَغْفِرْ لَنَا وَتَرْحَمْنَا لَنَكُونَنَّ مِنَ الْخَاسِرِينَ

‘হে আমাদের প্রতিপালক, আমরা স্বীয় নাফসের প্রতি যুলুম করেছি, যদি তুমি আমাদের ক্ষমা না করো এবং আমাদের প্রতি দয়া না করো, তবে অবশ্যই আমরা ক্ষতিগ্রস্তদের দলে গণ্য হব।’ (সূরা: আল
আরাফ, আয়াত: ২৩)।

(২) নূহ (আ.) এর দোয়া: মানব জাতির দ্বিতীয় পিতা নূহ (আ.) পিতা আদম (আ.) এর অষ্টম মতান্তরে দশম অধস্তন বংশধর। আল্লাহ তায়ালা তাকে সর্বপ্রথম রিসালাত দিয়েছেন। সে হিসেবে তিনি দুনিয়ার প্রথম রাসূল। আল্লাহ তায়ালা নূহ-পুত্র কেনআনসহ কওমে নুহকে তাদের অবাধ্যতার দরুন মহাপ্লাবনে ধ্বংস করে দিয়েছিলেন। সে সময় কতিপয় ঈমান আয়নকারীসহ তার তিন পুত্র (সাম, হাম ও ইয়াফিস) নূহ (আ.) এর সঙ্গে কিশতিতে আরোহণ করে ধ্বংসের হাত থেকে নাজাত পান। 

প্লাবন শেষে কেবল তার তিন পুত্রের বংশধরগণই অবশিষ্ট ছিল এবং তার পরবর্তী মানব সভ্যতা তাদেরই ধারাবাহিকতা। এজন্য নূহ (আ.)-কে মানব জাতির দ্বিতীয় পিতা বলা হয়। তিনি ৯৫০ বছরের দীর্ঘ জীবন লাভ করেছিলেন। এই দীর্ঘ সময়ব্যাপী তিনি স্বীয় সম্প্রদায়কে হেদায়াতের দিকে অবিরত আহ্বান করতে থাকেন। কিন্তু তার সম্প্রদায় সে আহ্বান প্রত্যাখান করে তাকে মিথ্যাবাদীর অপবাদ প্রদান করে। অত:পর নূহ (আ.) আল্লাহ তায়ালার দরবারে প্রার্থনা করলেন:

رَبَّهُ أَنِّي مَغْلُوبٌ فَانتَصِرْ

‘হে আল্লাহ! আমি অসহায়। অতএব, আপনি প্রতিবিধান করুন।’ (সূরা: আল কামার, আয়াত: ১০)।

رَبِّ إِنَّ قَوْمِي كَذَّبُونِ

فَافْتَحْ بَيْنِي وَبَيْنَهُمْ فَتْحًا وَنَجِّنِي وَمَن مَّعِي مِنَ الْمُؤْمِنِينَ

‘হে আমার প্রতিপালক! আমার সম্প্রদায় আমাকে মিথ্যাবাদী বলেছে; অতএব, আমার ও তাদের মধ্যে ফয়সালা করে দিন এবং আমাকে ও আমার সঙ্গী মুমিনদের রক্ষা করুন।’ (সূরা: আশ্ শু‘আরা, আয়াত: ১১৭-১১৮)।

رَّبِّ لَا تَذَرْ عَلَى الْأَرْضِ مِنَ الْكَافِرِينَ دَيَّارًا

إِنَّكَ إِن تَذَرْهُمْ يُضِلُّوا عِبَادَكَ وَلَا يَلِدُوا إِلَّا فَاجِرًا كَفَّارًا

‘হে আমার প্রতিপালক! ভূপৃষ্ঠে বসবাসকারী কাফেরদের একজনকেও তুমি অব্যাহতি দিও না। যদি তুমি তাদের অব্যাহতি দাও তবে তারা তোমার বান্দাদেরকে পথভ্রষ্ট করবে আর জন্ম দিতে থাকবে কেবল পাপাচারী, কাফের।’ (সূরা: নূহ, আয়াত: ২৬-২৭)।

(৩) ইব্রাহিম (আ.) এর দোয়া: নূহ (আ.) থেকে দুই হাজার বছরের ব্যবধানে মুসলিম জাতির পিতা ইব্রাহিম (আ.) এর আগমন ঘটে। তিনি ছিলেন আবূল আম্বিয়াহ্ বা নবীগণের পিতা। কেননা তার পরবর্তী নবীগণের প্রায় সকলেই তার বংশধর থেকে প্রেরিত হয়েছিলেন। 

তিনি পশ্চিম ইরাকের নিকটবর্তী বাবেল শহরে জন্মগ্রহণ করেন। তৎকালীন ঔদ্ধত্য সম্রাট নমরুতদের প্রধান পুরোহিত আযর ছিলেন তার পিতা। সকল নাবীর ন্যায় দাওয়াতী মিশন বাস্তবায়নের পাশাপাশি তিনি বহুবিধ সংস্কারমূলক কর্মসূচী বাস্তবায়ন করেন এবং নানা রকম কঠিন-অগ্নি পরীক্ষার সম্মুখীন হন। 

তিনি দরবারে ইলাহীতে যে প্রার্থনা করেছিলেন কোরআন মজিদে তা বর্ণিত হয়েছে। তিনি আল্লাহ তায়ালার দরবারে হেদায়েত কামনা করে এভাবে দোয়া করেছিলেন:

رَبِّ هَبْ لِي حُكْمًا وَأَلْحِقْنِي بِالصَّالِحِينَ

وَاجْعَل لِّي لِسَانَ صِدْقٍ فِي الْآخِرِينَ

وَاجْعَلْنِي مِن وَرَثَةِ جَنَّةِ النَّعِيمِ

‘হে আমার প্রতিপালক! আমাকে প্রজ্ঞা দান করো এবং আমাকে সৎকর্মশীলদের অন্তর্ভুক্ত করো আর আমাকে পরবর্তীদের জন্য সত্যভাষী করো এবং আমাকে সুখময় জান্নাতের অধিবাসীদের অন্তর্ভুক্ত করো। (সূরা: আশ্ শু‘আরা, আয়াত: ৮৩-৮৫)।

رَبِّ اجْعَلْ هَـَذَا بَلَدًا آمِنًا وَارْزُقْ أَهْلَهُ مِنَ الثَّمَرَاتِ مَنْ آمَنَ مِنْهُم بِاللّهِ وَالْيَوْمِ الآخِرِ 

‘হে আমার প্রতিপালক! এ নগরীকে নিরাপদস্থলে পরিণত করো এবং এর অধিবাসীদের মধ্যে যারা আল্লাহ ও পরকালের প্রতি বিশ্বাস রাখে তুমি তাদেরকে ফল-ফলাদি দ্বারা জীববিকা দান করো।(সূরা: আল বাক্বারা, আয়াত: ১২৬)।

رَبِّ اجْعَلْ هَـذَا الْبَلَدَ آمِنًا وَاجْنُبْنِي وَبَنِيَّ أَن نَّعْبُدَ الأَصْنَامَ

‘হে আমার পালনকর্তা! এ শহরকে তুমি শান্তিময় করে দাও এবং আমাকে ও আমার সন্তান-সন্ততিকে মূর্তিপূজা থেকে দুরে রাখো। (সূরা: ইব্রাহিম, আয়াত: ৩৫)।

কাবাগৃহ নির্মাণ সম্পন্ন করে পিতা-পুত্র (ইব্রাহিম ও ইসমাঈল) যে প্রার্থনা করেছিলেন তা যেমন ছিল অন্তরভেদি তেমনি সুদূরপ্রসারী ফলদায়ক। যেমন আল্লাহ তায়ালা বলেন, স্বরণ করো, যখন ইব্রাহিম ও ইসমাঈল কাবাগৃহ নির্মাণ করল এবং দোয়া করল:

رَبَّنَا تَقَبَّلْ مِنَّا إِنَّكَ أَنتَ السَّمِيعُ الْعَلِيمُ

رَبَّنَا وَاجْعَلْنَا مُسْلِمَيْنِ لَكَ وَمِن ذُرِّيَّتِنَا أُمَّةً مُّسْلِمَةً لَّكَ وَأَرِنَا مَنَاسِكَنَا وَتُبْ عَلَيْنَآ إِنَّكَ أَنتَ التَّوَّابُ الرَّحِيمُ

رَبَّنَا وَابْعَثْ فِيهِمْ رَسُولاً مِّنْهُمْ يَتْلُو عَلَيْهِمْ آيَاتِكَ وَيُعَلِّمُهُمُ الْكِتَابَ وَالْحِكْمَةَ وَيُزَكِّيهِمْ إِنَّكَ أَنتَ العَزِيزُ الحَكِيمُ

‘হে! আমাদের প্রতিপালক! তুমি আমাদের (এই খিদমত) কবুল করো। নিশ্চই তুমি সর্বশ্রোতা ও সর্বজ্ঞ’। প্রভু হে! তুমি আমাদের উভয়কে তোমার অজ্ঞাবহ করো এবং আমাদের বংশধরদের মধ্য থেকেও তেমার প্রতি একটা দল সৃষ্টি কর। তুমি আমাদেরকে হজের নীতি-নিয়ম শিখিয়ে দাও এবং আমাদের তাওবাহ কবুল করো। নিশ্চই তুমি তাওবাহ কবুলকারী ও অনুগ্রহশীল। হে আমাদের পালনকর্তা! তুমি এদের মধ্য থেকেই এদের নিকটে একজন রাসূল প্রেরণ করো, যিনি তাদের নিকটি এসে তোমার আয়াতসমূহ পাঠ করে শুনাবেন, তাদেরকে কিতাব ও হিকমত শিক্ষা দেবেন এবং তাদের পবিত্র করবেন। নিশ্চই তুমি পরাক্রমশালী ও দূরদৃষ্টিম্পন্ন। (সূরা: আল-বাক্বারাহ, আয়াত: ১২৭-১২৯)।

ইব্রাহিম (আ.) আল্লাহ তায়ালার কাছে নেক সন্তানের জন্য প্রার্থনা করে বলেন:

رَبِّ هَبْ لِي مِنَ الصَّالِحِينَ

‘হে আমার রব! আমাকে এক সৎকর্মপরায়ণ সন্তান দান করো।’ (সূরা: আস্ -সাফ্ফা, আয়াত: ১০০)।

(৪) লূত (আ.) এর দোয়া: লূত (আ.) ছিলেন মুসলিম মিল্লাতের পিতা ইব্রাহিম (আ.) এর ভ্রাতুষ্পুত্র। তিনি স্বীয় জন্মভূমি বাবেল শহরের মায়া ত্যাগ করে চাচা ইব্রাহিম (আ.) এর সঙ্গে বায়তুল মাকদিসের নিকটবর্তী কেনআনে হিজরত করেন। লূত (আ.) আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে নবুওয়াত লাভ করে জর্ডান ও বায়তুল মাকদিসের মধ্যবর্তী ‘সাদূম অঞ্চলের অধিবাসীদের হেদায়াতের লক্ষ্যে দাওয়াত প্রদান করেন। কিন্তু তার অবাধ্য সম্প্রদায় সে দাওয়াত প্রত্যাখ্যান করে। এমনকী তারা সমকামিতার মতো জঘন্য পাপাচারে অভ্যস্ত ছিল। তখন লূত (আ.) তাদেরকে এ জঘন্য কার্য থেকেও বিরত থাকতে বললেন। কিন্তু তারা তার কথায় কর্ণপাত না করে বরং তাকে নিয়ে ঠাট্রা-বিদ্রুপ করতে লাগল। তারা ঔদ্ধত্যের সীমা অতিক্রম করে লূত (আ.)-কে এলাকা থেকে বহিষ্কারের হুমকি দিয়েছিল। তখন লূত (আ.) আল্লাহ তায়ালার দরবারে দু’টি দোয়া করলেন।

(১) প্রথম দোয়াটি হলো:

رَبِّ نَجِّنِي وَأَهْلِي مِمَّا يَعْمَلُونَ

‘হে আমার প্রতিপালক! (তারা যা করে ) আমাকে ও আমার পরিবার-পরিজনকে এহেন দুষ্কর্ম থেকে রক্ষা করো।’ (৪৩-সূরা আশ্ শু‘আরাঃ১৬৯)

(২) অপর দু‘আটি হলো:

رَبِّ انصُرْنِي عَلَى الْقَوْمِ الْمُفْسِدِينَ

‘হে আমার প্রতিপালক! বিপর্যয় সৃষ্টিকারী সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে তুমি আমাকে সাহায্য করো। (সূরা: আল আনকাবুত, আয়াত: ৩০)।

আল্লাহ তায়ালা লূত (আ.) এর দোয়া কবুল করত: তাকে ও তার অনুসারীদের রক্ষা করলেন এবং সমকামিতায় লিপ্ত অধিবাসীদের নিশ্চিহ্ন করে দিলেন। কওমে লূত এর ধ্বংশস্থলটি বর্তমানে‘বাহরে মাইয়েত’ বা ‘বাহরে লূ ‘ অর্থাৎ ‘মৃত সাগর’বা‘লূত সাগর’নামে খ্যাত। যা ফিলিস্তিন ও জর্ডান নদীর মধ্যবর্তী বিশাল অঞ্চল জুড়ে নদীর রুপ ধারণ করে আছে। এর পানিতে তৈলজাতীয় পদার্থ বেশি। এতে কোনো মাছ, ব্যাঙ এমনকী কোনো জলজ প্রাণী বেঁচে থাকতে পারে না। এ কারণেই একে‘মৃত সাগর’ বা ‘মরু সাগর’ বলা হয়। চলবে...

-মুহাম্মদ গোলাম রহমান

নিউজওয়ান২৪.কম/আরাফ